লকডাউনে এবং নানা বিধিনিষিধের কারণে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেই ঘরে ফায়ার এসেছেন। পরিস্হিতি তেমন কোনো উন্নতি হয় নি। তাই অদূরভবিষ্যতে কাজ ফিরে পাওয়া বা পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের জায়গায়তে ফায়ার যাওয়া সম্ভবনা কম। বেকারিকত্বের হার ২৭% ছাড়িয়েছে। এই অবস্থায় শ্রমের বাজারে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভূত সম্ভবনা রাষ্ট্রসংঘের একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, সারা বিশ্বে অর্থনীতি ৩.২% হ্রাস পাবে। উন্নত দেশের হ্রাস এর হার তুলনামূলক বেশি ৫% আর উন্নয়্নশীল দেশের ক্ষেত্রে তা হবে ০.৭%। এরফলে প্রায় তিন কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে চলে যাবেন। উন্নত দেশে সামাজিক সুরক্ষা অনেক ভালো। ফলে যারা কাজ হারাবেন তাঁরা কিছুটা অন্তত সামাজিক সুরক্ষা পাবেন। কিন্তু উন্নয়্নশীল দেশে বেশিরভাগ শ্রমিক কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা পান না। ভারতবর্ষের মতো দেশে ৯০% অসংঘটিত শ্রমিক উল্লেখ করার মতো কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই।
একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, মে মাস প্রযন্ত আমাদের দেশে ১২ কোটির মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এঁদের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা আছেন। এটি যথেষ্ট রক্ষণশীল একটি পরিসংখ্যান।কাজ হারানো শ্রমিকের সংখ্যা আরো বেশি হবে। সরকারি তরফে পূর্ণবাসন প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। আত্মনির্ভর ভারত তৈরী করার ডাক দেওয়া হয়েছে। স্হানীয় অর্থনৈতিক উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও শিশুশ্রম বৃদ্ধির একটি অশনিসংকেতও রয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই বলা যায়, যখন আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি হয়, সেই পরিস্হিতিতে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পায়। যখন চাহিদা কম, উৎপাদনও কম এবং জীবিকার সংকট রয়েছে, সেই অবস্থায় শিশুশ্রমের চাহিদা এবং যোগান উভয়ই বাড়ে। বিষয়টি ভাবতে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকরাই কাজ পাচ্ছেন না সেখানে শিশুশ্রম কেন বাড়বে? কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই হয় এবং কিছু কারণের জন্য এই সম্ভবনা আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণগুলি এক এক করে আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত, যে সব শহর থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফায়ার এসেছেন যেমন দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, আহমেদনগর, চেন্নাই, পুনে ইত্যাদি আগামী কিছুদিনের মধ্যে কলকারখানা গুলো খুললে শ্রমিক জোগানে ঘাটতি দেখা যাবে। সেই ঘাটতি পূরণে শিশুশ্রমিকের নিয়োগ বাড়তে পারে। বিশেষত নির্মাণশিল্পে স্থানীয় শিশুশ্রমিক দিয়ে যোগান পূর্ণ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, লোকডাউনয়ে গ্রামাঞ্চলে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে এসেছেন সেখানে যোগান চাহিদার থেকে অনেক বেশি হবে এবং ফলস্বরূপ মজুরিরহার কমবে। স্থানীয় ছোট ও মাঝারি উৎপাদনকারীদের কম ব্যয়ে উৎপাদন করতে চাইবেন। চাহিদা অনেক কম, তাই উৎপাদন ব্যয় কম রেখে মুনাফা করাই উৎপাদনকারীদের প্রধান লক্ষ থাকবে। শিশুশ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক মজুরিতে নিয়োগ করা যায়, তাই এই পরিস্হিতিতে শ্রমের বাজারে শিশুশ্রমিকদের যোগান ও চাহিদা দুই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনা বাড়ছে।
তৃতীয়ত, লকডাউন অবস্থায় স্কুল কলেজ সবই বন্ধ থাকার ফলে অনেকেই স্কুলে যেতে পারছে না। অর্থসামাজিকভাবে পিছিয়েপড়া পরিবারের শিশুরা যে ধরণের স্কুলে যায় সেখানে অনলাইন পড়াশোনার বেবস্থা নেই বা সেইসব শিশুপরিবারের তেমন পরিকাঠামো নেই। ঘরে অভাব, অভিবাবকদের কাজ নেই, স্কুল হচ্ছে না আর বাইরে সস্তা শ্রমিকের ডাক এমতবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্থ এই অভিভাবকরা বাচ্চাদের শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দেবেন, এমন সম্ভবনা বেড়ে যায়। দিনেরশেষে দু'মুঠো ভাত-ডাল জোগাড় করে যখন দুস্কর, সেই অবস্থায় ঠিক-বেঠিক জ্ঞান না থাকারই কথা।
চতুর্থত, অনেক রাজ্যেই শ্রম আইন শিথিল করা হয়েছে। মনে করা হয়, শ্রম আইন থাকার জন্য নিয়োগকারীরা আরো বেশি মাত্রায় নিয়োগ করতে চান না। যদিও, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই বা বাস্তবে তার কোনো প্রমান নেই। তথাপি শ্রম আইনগুলো শিথিল করা হয়েছে এই আশায় যে, উদ্যোগপতিরা আরোবেশি মাত্রায় বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানে উৎসাহী হবেন। বাস্তবে যা হওয়ার সম্ভবনা সেটা হলো, শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়া।যেখানে সামগ্রিক শ্রম আইন শিথিল করা হয়েছে সেখানে শিশুদের কাজের জগতে নিয়োগের সম্ভবনা আরো বেড়ে যায়। আইন প্রণয়ন পরিকাঠামো দুর্বল করা হলে ন্যূনতম যে আইনগুলি আছে সেগুলি লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়ে। এখানে এটাও বলা যায় যে, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ এই দুটি রাজ্যে শিশুশ্রমিক নিয়োগের ঘটনা তুলনামূলক বেশি। শ্রম আইন শিথিল বা বিলোপ করার আগে কনভেশন ১৪৪ অনুযায়ী ত্রিপাক্ষিক সম্মতি নেওয়ার কথা কনভেশন ১৪৪ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থান (এইএলও) আর একটি কনভেশন যাতে ভারত রাজি হয়েছে এবং প্রয়োজনী হস্তাক্ষর করেছে। ত্রিপাক্ষিক আলোচনা ছাড়া প্রশাসনিক এদেশে শ্রম আইন বিলোপ বা শিথিল করা যায় না। এই নিয়ে এরই মধ্যে এইএলও আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। ভারতের শ্রম আইন প্রথম আসে ১৯৮৬ সালে। তারপর থেকে লাগাতার চেষ্টা করে শিশুশ্রম অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু আগের থেকে কম হলেও শিশুশ্রম এখনো যথেষ্ট পরিমানে রয়েছে। চারপাশে অনেকেই শিশুশ্রমিকেই আমরা কাজ করতে দেখি। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে, ভাট খাবারের দোকানে, গ্যারেজে, ইটভাটা, বাজিকারখানা, নির্মাণশিল্প- এই রকম অনেক ক্ষেত্রেই শিশুশ্রমিক কাজ করতে দেখা যায়। সরকারিভাবে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় এবং উদ্ধার করা শ্রমিকদের পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী বেবস্থা নেওয়া হয়। এরপরও যে শিশুশ্রমিক রয়ে গিয়েছে তার কারণ একটা শিশুদের কম খরচে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়, তবে অন্য কারণ হচ্ছে এই বিষয়ে সামাজিক সহনশীলতা। শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে যেন কোথাও একটা প্রচ্ছন্ন যুক্তি রয়েছে এবং তা হলো, গরিব পরিবারে আর্থিক সংস্থান এর জন্য এই শিশুরা কাজ করছে এবং তাদের এই কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না। যখনি কোনো শিশুশ্রমিকে সরকারি উদ্যোগে উৎধার করতে যাওয়া হয় তখনি তাদের তাদের সামাজিক বাধা পেরিয়ে ব্যবস্থা নিতে হয়।প্রশ্ন উঠে, কেন তারা গরিব পরিবারের রুটিরুজি করতে এসেছেন। সমাজের সব স্তরে এমনকি প্রশাসনিক স্তরেও শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে এখনো ১০০% ঐক্যমত গড়ে তোলা যায়নি।
২০১৬ সালে শিশুশ্রম সংশোধন আনা হয়, সেখানে ১৪ বছরের নিচে শিশুদের সবধরণের কাজ থেকে বিরত করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালের আইন শর্ত সাপেক্ষে কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের কাজ করার অনুমতি ছিল। ২০১৬ সালের সংশোধনীতে সবক্ষেত্রেই শিশুশ্রম রড করার কথা বলা হয়েছে, এটি একটি ভালো দিক। তবে একটি খারাপ দিকও রয়েছে, এই সংশোধনীতে বলেছে শিশু তার বাবা মা পারিবারিক ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবে এরফলে পিছনের দরজা দিয়ে শিশুশ্রম বাড়তে পারে, বিশেষত গত তিন দশকে কাজের জগতে যে সব পরিবর্তন হয়েছে এবং করোনার মরসুমে আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের ফলে পরিস্হিতি আরো সঙ্গিন হয়েছে।কাজের জগতে পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো উৎপাদনের বিকেন্দ্রীকরণ এর প্রবণতা এবং আউটসোর্সিং। আর ফলে আজকের দিনে অনেক কাজই কলখারখানার বাইরে হয় এবং আউটসোর্সিং হতে হতে গৃহস্থ পরিসরে পৌঁছে গিয়েছে। নিয়োগকারী এবং শ্রমিকের মাঝে বিভিন্ন স্তরে মধ্যস্থতাকারী রয়েছেন। শ্রমিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসংঘটিত রয়ে গিয়েছেন এবং তাদের উত্তাপাদনের কাজ গৃহস্ত পরিসরে করতে হয়, এবং এই গৃহস্ত পরিবারে শিশুদের পারিবারিক শিল্পে বাবা মাকে সাহায্য করার অনুমতি রয়েছে, এটি একটি সুক্ষরেখা ফলে গৃহস্ত পরিসরে কত শিশুশ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে সেটা জানা যায় না। ধূপকাঠি তৈরী, বিড়ি শিল্প, পোশাক তৈরির অনেক শিল্প এবং কুটিরশিল্পে অন্তর্গত অনেক কাজ গৃহস্ত পরিসরে হয়ে থাকে। এই সব ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিকের ব্যাবহার হলেও আইন অনুযায়ী বেবস্থা নেওয়া বেশ কঠিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন আর্থিক দুরবস্থার কারণে শিশুরা খুবই অসহায় অবস্থায় রয়েছে। যখন বেঁচে থাকবার ন্যূনতম রসদের অভাব ঘটে তখন শিশুরা সবচেয়ে বেশী শোষণের শিকার হয়।
শিশুশ্রম বিষয়টি বোরো জটিল। আমাদের মতো দেশে যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের যথেষ্ট কাজ নেই, সেখানে শিশুশ্রমের ব্যবহার অস্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও হচ্ছে ও যথেষ্টভাবে হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে দেখতে গেলে যে কারণটা সামনে আসে সেটি হলো, সবচেয়ে কম ব্যয়ে উত্পাদন। শিশুদের কম মজুরি দেওয়া হয় এবং অনেক বেশি সময় কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। যেমন কার্পেট শিল্পে নরম হাতের ব্যবহার সুবিধাজনক এবং দৃষ্টিশক্তিও গুরুত্ত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, অসংঘটিত ক্ষেত্রে যেখানে মুনাফা অর্জনের সুযোক অনেক কম, সেখানে উতৎপাদন ব্যয় কমিয়ে কিছুটা মুনাফা অর্জনের জন্য শিশুশ্রমের ব্যবহার হয়। শিশুশ্রমিকরা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে জানে না, নিয়োগকারীরা সেটির সুযোগ নেয়। দিনএর শেষে আমাদের দেশে শিশুশ্রমের একটি বাজার আছে আর তার সঙ্গে সামাজিক সোহনশীলতাও রয়েছে। গরিব পরিবারগুলি এটাও ভাবে যে, বাচ্চাদের কাজ করতে পাঠিয়ে কিছু রোজগারের উপায় হবে। সাময়িক কিছু রোজগারের আশায় বাবা-মাই শিশুদের ভবিষৎ নষ্ট করেন। যেই সময়ে শিশুরা শারীরিক মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয় সেই সময়ে শ্রমের বাজারে নিয়ে ফেললে শিশুদের স্থায়ীভাবে যে ক্ষতি হয়, তা পরবর্তীকালে তাদের শ্রমের বাজারে বা সামাজিক জীবনের জন্য অযোগ্য করে তোলে। এই ব্যাপারে সামাজিক সচেনতা তৈরির কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। ইদানিং মানসিক স্বাস্থ নিয়ে সমাজজীবনে চর্চা চলছে, কিন্তু শিশুশ্রমিকদের মধ্যে যারা আর্থসামাজিক দিক থেকে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে তাদের মানসিক সাস্থ, শারীরিক সুস্থথা নিয়ে উদাসীনতা দেখা যায়। আমরা এমন জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছি জেকলহানে শিশুশ্রম উর্ধমুখী হওয়ার প্রভূত সম্ভবনা। মানুষ কাজ হারিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা ফায়ার এসেছেন, বাজারে চাহিদার অভাব, উত্পাদন কম, অর্থনীতির পারদ ক্রমাগত নিম্নমুখী এই সময়ে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে আমরা খুব সম্ভবত প্রান্তিক শিশুদের কাজের বাজারে কুৎসিত নিষ্ঠুর দুনিয়ায় ঠেলে দেব। অনেক বাধা সত্ত্বেও শিশুশ্রম নির্মূলে গত তিন বছরে যা অগ্রগতি হয়েছিল, সেই গতি পিছিয়ে যেতে পারে। আমরা পিছনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি যদি না সচেতনভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা হয়। শিশুশ্রম সামাজিক অভিশাপ। যত তাড়াতাড়ি আর থেকে মুক্তি পাব, তত ভালো। মুক্তি পাওয়ার জন্য এই সমস্যার থেকে মুখ সরিয়ে না নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম দুরিকরণ কোনও একটি সরকারি দপ্তরের দায় হতে পারে না, এটি সামাজিক দায়, আমাদের সবার দায়। শিশুশ্রম নিয়ে অনেক সেমিনার হয়, আর সেই সব সেমিনার চায়ের কেটলি নিয়ে ঘোড়া শিশুর কাছ থেকে আমরা দিব্বি চা খাই। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক পূর্ণগঠনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুশ্রম যাতে না বারে সেই দিকে নজর রাখতে হবে। সবাইমিলে চেষ্টা করলে অদূরভবিষ্যতে দেশকে শিশুশ্রম মুক্ত করতে পারবো। উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যে আরেকটু এগিয়ে যাওয়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
If you have any doubts, please let me know