রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

রাজবংশী সমাজে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার শিক্ষা


উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিভাবান সমাজ সংস্কারক ও যুগপুরুষ পঞ্চানন বর্মা অবহেলিত, নিপীড়িত, আর্তসমাজে ছিলেন মুক্তিদূত। তিনি ছিলেন জনদরদি, জননায়ক, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, সুসাহিত্যিক, নারীমুক্তি আন্দোলন এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পথিকৃৎ। ওঁনার বাল্যজীবনে শিক্ষার শুরু গ্রামের পাঠশালায়। ১৮৮৫ সালে মাথাভাঙ্গা স্কুলে থেকে মধ্যে ইংরেজি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস এবং রাজশাহি বিভাগে (কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, রংপুর ও মালদা জেলা) প্রথম স্থান অধিকার করে জীবনের শুরুতেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালে কোচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (উচ্চ ইংরেজি) পাস করার পর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে সংস্কৃত শাস্ত্রে অনার্স সোহো বিএ পাস করেন। তিনিই ছিলেন অবিভক্ত বাংলা, বিহার, অসমের রাজবংশী সমাজের মধ্যে প্রথম, যিনি এই শিক্ষা অর্জন করে ছিলেন।

 উচ্চশিক্ষা শেষে কর্মজীবনে তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যে সম্মানযোগ্য পদ না মেলায় তিনি ১৯০১ সালে পার্শ্ববর্তী জেলা রংপুর জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। উচ্চশিক্ষিত এমএ বিএল উকিল পঞ্চাননকে রংপুর জজকোর্টের বারে হেনস্তা হতে হয়। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। অদম্য উৎসাহ নিয়ে তিনি ওকালতির সঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রংপুর শাখার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ত্রৈমাসিক রংপুর সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় সম্পাদক পদ অলংকার করেন। তিনি ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত সম্পাদক পদে ছিলেন। এই কয়েক বছরে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি রচনা করেন। পঞ্চানন বর্মার মূল্যবান রচনাগুলি "কথা ও ছিল্কা", "রংপুরের রূপকথা" শিরোনামে প্রকাশ করেছেন। এছাড়া "বাহা সে বান্ধব", "জগন্নাথী বিলাই" ইত্যাদি তাঁর রচনাশৈলী ও ভাষা সাহিত্যে গভীর জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।

ওকালতি এবং সাহিত্য সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি অবহেলিত, অত্যাচারিত, বঞ্চিত, হতদরিদ্র বিশাল রাজবংশী সমাজের উন্নতিবিধানে আত্মনিয়োগ করেন। সেই সময় সমাজে গভীর নৈরাজ্য ও ক্ষোভ চলছিল। যুবকের মতো কর্মশক্তি, উদ্যম, সাহস, সংগঠনশৈলী, দৃঘ্যতা, নির্ভীকতা নিয়ে নিজের এবং জাতির অপমানে অপমানিত হয়ে ওকালতি এবং সাহিত্য সেবা জলাঞ্জলি দিয়ে সমগ্র রাজবংশী সমাজের ক্ষত্রিয় আন্দোলনে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন ঠাকুর পঞ্চানন।

উত্তর বাংলায় ক্ষত্রিয় আন্দোলনের সময় হিন্দুধর্ম ত্যাগের প্রবণতা প্রচণ্ডভাবে দেখা দিয়েছিলো। পঞ্চানন বর্মার ক্ষত্রিয় আন্দোলন শুধু রাজবংশী সমাজকেই রক্ষা করেনি, গোটা হিন্দু সমাজকেই ধর্মত্যাগের প্রবণতা থেকে রক্ষা করেছিলেন। অনেকেই এই সময়টিকে পঞ্চাননের যুগ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। উত্তরবাংলার হিন্দুসমাজ পঞ্চানন বর্মার কাজে কৃতজ্ঞ। পঞ্চানন বর্মা রাজবংশী তরুণদের ক্ষত্রিয়োচিত সাহস, বীরত্ব, শৃঙ্খলাবদ্ধ, ও আত্মত্যাগের শিক্ষা এবং পরীক্ষায় উত্তির্ন হওয়ার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগদানের উৎসাহিত করেছিলেন। এর মাধ্যমে বৃহৎ জগতের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটেছিলো। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে স্বীয় সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণে রাজনীতির আঙ্গিনায়, আইনসভার ভিতরে ও বাইরে তাঁর যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন। পিছিয়ে পড়া স্বীয় সমাজকে টেনে তোলার জন্য আমৃত্যু তিনি কর্তবনিষ্ঠে থেকে সমাজের উদাহরণ সৃষ্ঠি করেছিলেন। ক্ষত্রীয় সমাজের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রেরণা তিনি। আজ শিক্ষা ও জীবিকা সহ সর্বক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় সমাজের যে অগ্রগতি, তার মুলে পঞ্চানন বর্মার কর্মকান্ড ও প্রেরণা রয়েছে।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

If you have any doubts, please let me know

বিরোধিতা মানে শুধু অন্ধ বিরোধিতা নয়

আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন, গ্যাস আর দাম যথেষ্ট উদ্বেগ বাড়িয়েছে যার প্রভাব দেশের জনগণের সঙ...